Different types of Indian music // ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন প্রকার

Different types of Indian music // ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন প্রকার

ভারতীয় সঙ্গীতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

৬৪ কলার মধ্যে সঙ্গীতকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ কলা বিদ্যা। সঙ্গীত সম্পর্কিত প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ “সঙ্গীত পারিজাত” গ্রন্থের রচয়িতা অহোবল সঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “গীতং, বাদ্যং, নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীত মূচ্যতে” অর্থাৎ গান, বাদ্য ও নাচ এই তিনটির সম্মিলিত রূপকেই সঙ্গীত বলে। কিন্তু শাস্ত্র যাই বলুক মনের কথা সুর দিয়ে প্রকাশ করাকেই সঙ্গীত বলে মনে করি আমি; সে হোক যন্ত্র, মন্ত্র, কণ্ঠ কিংবা নৃত্যের মাধ্যমে। সঙ্গীতের উৎপত্তি মানব সৃষ্টির মতই অজানা। কখন ও কোথায় এ রহস্য কিন্তু আজও উন্মোচিত হয়নি। কোনটা কার আগে সৃষ্টি তার সঠিক তথ্য আজও মেলেনি। কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব অজ্ঞাত থাকলেও রয়েছে এর ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার আদলে উদ্ভব হয়েছিল সঙ্গীতের নতুন নতুন ধারা ও রূপ, আবার পালাক্রমে তা হয়েছে লুপ্ত।

সঙ্গীতের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা বিশ্ব সঙ্গীতের আলোকে করা বেশ গবেষণা ও সমন্বয়ের বিষয়। অন্যদিকে বিশ্বসঙ্গীতে ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রয়েছে বিপুল প্রভাব বিস্তারকরনের ক্ষমতা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলতে যদি কেউ বুঝে থাকেন বর্তমান ভারত নামক দেশের সঙ্গীতকে তাহলে বিরাট ভুল হবে। ৪০০০ বছর পুরানো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দাবীদার ও চর্চার ক্ষেত্র শুধু বর্তমান ভারত নয়, বৈদিক যুগ হতেই সমগ্র উপমহাদেশ(বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ) এ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির গর্বিত ধারক ও বাহক। ভারতীয় উপমহাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থানে থাকার প্রেক্ষিতে ভারতীয় সঙ্গীতের আলোকে সঙ্গীতের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা করা উপযুক্ত মনে করেছি আমি।

ভারতীয় সঙ্গীতের ভিত্তি গড়া এবং পর্যায়ক্রমে বেড়ে উঠতে লেগেছে হাজার যুগ ও মনিষীদের অবদান। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের উদ্ভব ও বিকাশকে নিন্মোক্ত ৫টি যুগ ভেদে ভাগ করে তুলে ধরা যায়:

১। সিন্ধু সভ্যতা যুগ(খ্রিষ্টপূর্ব৩০০০-২০০০)

২। বৈদিক যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব২০০০-১০০০)

৩। বৈদিকত্তর যুগ (খ্রিষ্টপূর্ব১০০০-খ্রিষ্টাব্দ১২০৬)

৪। মধ্যযুগ (১২০৭-১৭৫৭খ্রিঃ)

৫। আধুনিক যুগ (১৭৫৭- বর্তমান)


১। সিন্ধু সভ্যতা যুগ – খ্রিষ্টপূর্ব(৩০০০-২০০০)

সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠা সিন্ধু সভ্যতায় প্রকৃতি পূজারী মুনি-ঋষিদের কাছে ভারতীয় সঙ্গীত হল দেবদেবী হতে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক জ্ঞান। সে সময় সাম বেদের মন্ত্র গুলি সাধারণভাবে গাওয়া হত, তাই প্রথম অবস্থায় ৩ টি নোট(সা, রে, গা) দিয়েই কাজ চলে যেত। মন্ত্র উচ্চারণের স্বরাগমও ছিল সহজ।যেমন – গা গা -রে রে -সা সা সা । উপমহাদেশের প্রাচীন সঙ্গীতের পরিচয় পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতা যুগে(খ্রিষ্টপূর্ব৩০০০-২০০০) পাওয়া মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার  অনেক মূল্যবান নিদর্শনের পাশাপাশি নানা প্রকার চামড়ার বাদ্যযন্ত্র, তন্ত্রীযুক্ত বীণা, বাঁশী, মৃদঙ্গ, করতাল ও নৃত্যশীলা নারীমূর্তি ইত্যাদির মাধ্যমে। এ যুগের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত ছিল বলে জানা যায়।

২। বৈদিক যুগ – খ্রিষ্টপূর্ব (২০০০-১০০০):

বৈদিক যুগে খ্রিষ্টপূর্ব(২০০০-১০০০) গড়ে উঠাসামগ নামে আচার্যদের তত্ত্বাবধানে তিনটি স্বরকে(স ম গ) নিয়ে সামবেদের মন্ত্রগুলোকে সুর করে গাওয়া হত। তাছাড়া, বেদের মন্ত্রগুলোকে সুর দিয়ে গাওয়ার জন্য সাম বেদ নামে আলাদা একটি অংশ ভাগ করা হয়। সামবেদের সঙ্গীতকে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে দু ধরণের গান ছিল; সমবেত সঙ্গীত, আর বাকি দু ধরণের ছিল একক সঙ্গীত। একপর্যায়ে ঋষিরা লক্ষ্য করেন তিনটি নোট দিয়ে কাজ চলছিল না। প্রকৃতি পূজারী ছিলেন বিধায় সবকিছুতেই প্রকৃতি নির্ভর ছিলেন প্রাচীন ঋষিরা। বিভিন্ন পশুপাখির আওয়াজ শুনে তাঁরা তৈরি করলেন সাতটি স্বর বা নোট। যথাক্রমেঃ

ষড়জ (সা), ঋষভ (রি), গান্ধার (গা), মধ্যম (মা), পঞ্চম (পা), ধৈবত (ধা), নিষাদ (নি)

সামবেদে মোট ৪৯ রকমের তাল, ২১ রকমের মূর্ছনা আর ৭ টি মূল স্বর এর উল্লেখ আছে। ভিন্ন ভিন্ন দেবতা হতে প্রাপ্ত জ্ঞান হিসেবে বিভিন্ন প্রাণীর ডাকের সাথে মিলিয়ে প্রাচীন ঋষিরা স্বরগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ রেখে দেহের অভ্যন্তরীণ যোগশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক চক্রে প্রতিস্থাপন করে স্বরগুলোকে প্রচলন করেন। নিচের ছবিটি দেখলে পুরো ব্যাপারটি ভালভাবে বোঝা যাবে।

1 swar

স্বরের উৎপত্তি, অর্থ, যোগচক্রানুযায়ী অবস্থান ও সংশ্লিষ্ট দেবতা

বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট পিগট বৈদিক যুগের গানে সাত সুরের ব্যবহার নিয়ে বলেছিলেন, “There are some interesting evidence for Aryan Music. Cymbals were used to accompanying dancing, and in addition to this and the drum there were reed flutes or pipes, a stringed instrument of the lute class, and sharp of lyre which is mentioned as having seven tones or notes. This last piece of information is important for our knowledge of ancient music.”1

৩। বৈদিকত্তর যুগ – খ্রিষ্টপূর্ব(১০০০-খ্রিষ্টাব্দ১২০৬)

ইতিমধ্যেই প্রাচীন সাতটি স্বর থেকে আরো পাঁচটি উপস্বর জন্ম নিয়ে স্বরের সংখ্যা দাঁড়ালো ১২ টি। বৈদিকত্তর যুগ(খ্রিষ্টপূর্ব১০০০-খ্রিষ্টাব্দ১২০৬) ও পরবর্তী সময়ের প্রামাণ্য সঙ্গীত গ্রন্থ নামে পরিচিত ভরত রচিত “নাট্যশাস্ত্র” ও মতন্নগ রচিত “বৃহাদ্দেশী” গ্রন্থগুলোতে সঙ্গীত এবং এর শ্রুতি, স্বর,মূর্ছনা, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদির বর্ণনা পাওয়া যায়। ভরত ছাড়াও মতঙ্গ, বিট্ঠল, দামোদর, সোমনাথ, অহোবল, ব্যাঙ্কটমুখী, হৃদয়নারায়ন দেব, পণ্ডিত ভাবভট্ট, শ্রীনিবাস, মহাকবি কালিদাস ইত্যাদির সংগীত শাস্ত্রবিদের নাম ও তাদের রচিত নানা পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়। তৎকালীন সমাজ ও সভ্যতা গড়ে ওঠা সাংগীতিক মহলের বড় প্রমাণ হল সংস্কৃত সাহিত্যের মহাভারত, রামায়ণ ও বৈষ্ণবদের সঙ্গীত বিষয়ক তথ্য উপাত্তগুলো ।

2 Corja

চর্যাপদের গীতি

একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ শাসনামলে গড়ে উঠা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজ ব্যবস্থায়ও সংগীতের ছাপ সুস্পষ্ট। সম্রাট সমুদ্র গুপ্তকেও তাঁর আমলের স্বর্ণমুদ্রায় বীণা হাতে দেখা যায়। সন্ধ্যা ভাষায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য কর্তৃক রচিত “চর্যাগীতি” এবং বিভিন্ন তত্ত্ব ও আধ্যাত্মবাদকে জোর দিয়ে রচিত বজ্র গীতিগীত গোবিন্দ”  গুলো তৎকালীন নানা উৎসবে গাওয়া হত।

৪। মধ্যযুগ – (১২০৭-১৭৫৭খ্রিঃ)

সংগীতের স্বর্ণযুগ বলায় হয় মধ্যযুগকে(১২০৭-১৭৫৭খ্রিঃ)। মধ্যযুগের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় সঙ্গীত শুধু তৎকালীন হিন্দু ও বৌদ্ধদের আয়ত্তে ছিল। এ সময় ভারতীয় সঙ্গীতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বিভিন্ন গায়কী, ঘরানা বা স্টাইলের প্রভাবে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়ে বিকাশ ঘটতে থাকে সঙ্গীতের নতুন নতুন ধারার। তৎকালীন সময়ে বড়ু চণ্ডিদাস রচিত ‘শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন’  গ্রন্থে দেব দেবীর পূজার্চনায় কীর্তনের প্রমাণ মেলে। এ সময়কালের রাজা,সুলতান, শাসকেরা সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগে সঙ্গীত আসে আমূল পরিবর্তন। ভারতবর্ষের সংগীতে পারস্যের ছোঁয়া লেগে দুটি ধারায় বিভক্ত হয় ভারতীয় সঙ্গীতঃ

ক. হিন্দুস্তানি

খ. কর্ণাটকি

ক. হিন্দুস্তানি:

পারস্য ও আরবের সংগীতের সাথে মিশ্রিত হয়ে ভারতীয় সঙ্গীতে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত  নামে নতুন রূপ সৃষ্টি হয়। বৈদিক দর্শন, ভারতের দেশজ শব্দ-সুর এবং পারস্যের সাংগীতিক প্রভাবে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এর বিমোহন ক্ষমতার জন্য। সাতটি সুর ও ২২টি শ্রুতির সমন্বয়ে আরোহণ-অবরোহণ বিন্যাস, বাদী-সমবাদী স্বরের প্রয়োগ, মীড়, গমক ও অন্যান্য সাংগীতিক কৌশলের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রাগসমূহ পরিবেশন করা হয়। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারা সমসাময়িক ধর্মীয়, লোকগীতি এবং নাট্যকলার সাঙ্গীতিক প্রকাশ হতে স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে। খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার, ঠুমরী, তারানা, ইত্যাদি সাংগীতিক ফর্মগুলো এসময় উৎকর্ষতা লাভ করে।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর সভা গায়ক আমীর খসরু, জৌনপুরের শাসক সুলতান হুসেন শর্কী, ধ্রুপদের আবিষ্কর্তা গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমর, তাঁর সভা গায়ক বখশ, রাণী মৃগনয়নী ছিলেন সঙ্গীতের মধ্যযুগের দিকপাল। মোগল আমলে সম্রাট আকবরে সংগীতের অনেক কদর ছিল। অবাক করার মত হলেও সত্যি যে, আবুল ফজলের “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে সম্রাট আকবরের ৩৬ জন সংগীতজ্ঞের নাম পাওয়া যায়। সম্রাট আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, এবং আওরঙ্গজেবের আমলেও সংগীতের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। “সদা-রঙ্গিলা বা চির প্রফুল্ল” খ্যাত সংগীতজ্ঞ সর্বশেষ মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের আমলে সঙ্গীত চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। তাঁর দরবার সঙ্গীতবিদদের পুণ্যস্থান বলে প্রচলিত ছিল। শ্রেষ্ঠ সংগীত কলাকার; প্রসিদ্ধ খেয়াল গানের রচয়িতা সদারঙ্গ ও অদারঙ্গ তাঁর দরবার অলংকৃত করেছিলেন, যাদের নাম ভারতীয় সঙ্গীত তাঁর অস্তিত্বের ইতিহাসে চিরজীবন মনে রাখবে।

3 artworkmain

রাজদরবারে সঙ্গীত পরিবেশন

খ. কর্ণাটকিঃ

দক্ষিণ ভারতে উদ্ভূত কর্ণাটকি সঙ্গীত বৈদিক সংস্কৃতি মেনে নিয়ে অপরিবর্তিত থেকে যায় বলে একে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আদি রূপ বলা হয়। কর্ণাটকি সঙ্গীতে ৭২টি শ্রুতি(মেলোডিক কোড) রয়েছে যেগুলোকে মেলাকারটা রাগ বলা হয়। এর সাথে সঙ্গত করবার জন্য রয়েছে ১০৮ ধরনের তাল।



দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে স্বরগুলোর ভিন্ন কম্পাঙ্কের অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, রাগসঙ্গীতে একই স্বরের আলাদা আলাদা শ্রুতি (আলাদা আলাদা কম্পাঙ্কের শব্দ) রাগ অনুযায়ী ব্যবহার তত্ত্বগতভাবে স্বীকার করা আছে। সাধারণতঃ শিল্পীরা চেষ্টা করেন সেই ভিন্নতা বজায় রাখার। যদিও এই আলাদা শ্রুতিগুলোর কম্পাঙ্ক একেবারে অনড় বা অপরিবর্তনীয়ভাবে বলে বেঁধে দেওয়া নেই। এ কারণেই সব রাগের স্বর দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে ঐরকম রে১,রে২, নি১, নি২ ইত্যাদি লিখে স্বরের শ্রুতিস্থান বোঝানো হয়। বেশ কয়েক দশক ধরেই পাশ্চাত্য স্কেলের পূর্ণ অনুকরণে সা থেকে নি পর্যন্ত মাত্র ১২টি অনড় স্বর বা শ্রুতিস্থান ব্যবহার করেই প্রাচীন ভারতীয় শ্রুতি-নির্ভর স্বরগুলির পরিবর্তে উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশন করা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী শিল্পী অবশ্যই আছেন যারা মূলপদ্ধতি অনুসরন করে চলেন।

কর্ণাটকি সঙ্গীতে অবদানের জন্য যিনি “পিতামহ” বা কর্ণাটকি সঙ্গীতের “পিতা” নামে খ্যাত তিঁনি Purandara Dasa (1480–1564) প্রায় ৪,৭৫,০০০ সঙ্গীত রচনা করেছেন যার বেশীর ভাগই হারিয়ে গেছে। পরবর্তী যুগের কর্ণাটকী সঙ্গীতের রচয়িতাদের প্রেরণা ছিলেন তিঁনি। এরপরেই রয়েছেন কর্নাটকি সঙ্গীতের ত্রিবর্গ  (Trinity of Carnatic music) নামে পরিচিত Tyagaraja(1759? – 1847), Muthuswami Dikshitar(1776–1827)এবং Syama Sastri(1762–1827)

কর্ণাটকি রচয়িতারা মূলত ধার্মিক। তাঁরা কন্নড, মালায়ালাম, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় জ্ঞানী ছিলেন। নিজেদের রচনায় তাঁরা নিজ পরিচয় জুড়ে দিতেন। যেমনঃ Tyagaraja তেলেগু ভাষায় রচনা করে মুদ্রা (নিজ নাম) বন্দীশে জুড়ে দিতেন, ঠিক তেমনি Muthuswami Dikshitar সংস্কৃত ভাষায় রচনা করে Guruguha  মুদ্রা ব্যবহার করতেন, Purandaradasa কন্নড ভাষায় রচনা করে Purandara Vittala, Gopalakrishna Bharathiতামিল  ভাষায় রচনা করে Gopalakrishnan, এছাড়াও কর্ণাটকী সঙ্গীতের ত্যাগরাজা(Tamil Tyagaraja of Carnatic music) হিসেবে পরিচিতPapanasam Sivan তামিল ও সংস্কৃত ভাষায় রচনা করে Ramadasan মুদ্রা ব্যবহার করতেন।

৫। আধুনিক যুগঃ

আধুনিক যুগে অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের প্রথম কয়েকটি দশক সঙ্গীতের যাত্রা কিছুটা স্তিমিত থাকলেও বন্ধ ছিল না। জয়পুরের মহারাজা প্রতাপ সিংহ সঙ্গীত সম্মেলনের মাধ্যমে মিলিত করেন ভারতবর্ষের সেরা সংগীতজ্ঞদেরকে। সেখান থেকে রচিত হয়য় “সঙ্গীতসার” নামে মূল্যবান একটি গ্রন্থ।বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকর ও পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ন ভাতখন্ডে ভারতীয় সঙ্গীতে বিপুল সংস্কার আনেন। পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ন ভাতখন্ডে ৬০,০০০ রাগ-রাগিনীকে ১০ টি ঠাটে অন্তর্ভুক্ত করে রাগের আবিষ্কার ও প্রচলনের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন।

6 13624

সঙ্গীত সম্মেলন

এ সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত(হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকি) ও পশ্চিমা উপমহাদেশের সঙ্গীত পরষ্পর পরস্পরের সাথে তাল মিলিয়ে গড়ে তোলে এক মেলবন্ধন। অদ্ভূতভাবে এই দুই ধরণের সঙ্গীতের স্বর বা নোটে পুরো মিল দেখে মনে হতে পারে কেউ কারোরটা নকল করেছে। ছবিতে ওয়েস্টার্ন নোট সাথে ভারতীয় নোট এর সম্পর্ক দেখলে পুরোপুরি বোঝা যাবে।

comparison
ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সামঞ্জস্যতা

এ সময় সমগ্র ভারতবর্ষে সঙ্গীত ও সঙ্গীতবিজ্ঞদের আলোকের বেগে বিচ্ছুরন ঘটতে থাকে। পাটনায় রইস মোহাম্মদ রাজা, দিল্লীতে ওস্তাদ ওয়াজীর খাঁ, বোম্বাইয়ের পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ন ভাতখন্ডে,  মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত ভি.জি. যোগ, উত্তর প্রদেশের ওস্তাদ মসিত খাঁ, বাকুড়ায় গোকুলচন্দ্র নাগ,যদুভট্ট, লৌখনৌর খলিফা ওয়াজেদ হোসেন খাঁ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব্দর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, আলী আকবর খাঁ, আফতাবউদ্দীন খাঁ,বারণাসীতে পণ্ডিত কিষেন মহারাজ,পন্ডিত রবিশংকর, পাঞ্জাবে ওস্তাদ আল্লারাখা, রাজশাহীতে রাধিকামোহন মিত্র, বরিশালে শীতলচন্দ্র মুখোপাধায়,বিহারে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ, গৌরীপুরে বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, জোড়াসাঁকোর তিমির বরন ভট্টাচার্য, গোয়ালিয়রে ওস্তাদ হাফেজ আলী খাঁ,কলকাতায় কৃষ্ণানন্দ ব্যাস, স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ সহ অসংখ্য সঙ্গীতবিশারদের জন্মদাত্রী ভারতবর্ষীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরম ছায়ায় বেড়ে উঠে আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের নানা বিভাগ। হাজারো পীর, ফকির, দরবেশ, বাউল, ও লোককবির পূণ্যভূমির এ উপমহাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের নানা বিভাগের পাশাপাশি লোকগানের উত্তরণ কখনো স্থিরতো ছিলই না বরঞ্চ অনেক গতিশীল ছিল। ভজন, কীর্তন,কবিগান, তরজা, ঝুমুর, যাত্রাগান, রামায়ণের গান, গাজীর পালা, পাঁচালী, মনসা মঙ্গল, মহুয়ার পালা, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, ধুয়া, জারি,সারি, মারফতি, মুরশিদি, মরশিয়া, বারাশিয়াসহ নানা ধরনের পালাগান, ব্রম্মসংগীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসংগীত, জাগরণী, অতুল প্রসাদের গান,রজনীকান্তের গান, আধুনিক গান ও শ্যামাসংগীতসহ নানা রূপ ও ভাগে সমৃদ্ধ হয়ে আছে বাংলাগান।

অনেক পপ, রক, আধুনিক, রবীন্দ্র, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে শুধু গলা সাধার যন্ত্র মনে করেন যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারনা। ধ্রুপদ, খেয়াল, তারানা, ত্রিবট, চতুরঙ্গ শুনলে হয়ত বুঝবেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কোন ব্যাকরন বা ব্যায়াম নয়, গানের মত করে উপভোগ কিংবা চর্চার মতই একটি বিষয়। কোন দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সে দেশের কোন সঙ্গীত ধারার জননী বা ‘বেসিক’ ভাবাটা ভুল। অন্যদিকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দখল থাকলেই যে সকল ধরনের গান গাওয়া সম্ভব সেটিও ঠিক নয়। উদারণস্বরুপ বলা যায়, নজরুল সঙ্গীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল বলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী কোন শিল্পী নজরুল সঙ্গীতে অত্যন্ত পারঙ্গম হবেন সেটা ভিত্তিহীন। এজন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানগুলো রচনার সময় সনাতনী ধারাকে এড়িয়ে ক্লাসিক পর্যায়ের না করে আধুনিক ঘরানার গান হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইতেন।

বর্তমানে ভারত সরকার ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রসারে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছেন। সেখানকার স্কুল কলেজে পাঠ্যসূচীর মধ্যে সঙ্গীত অন্যতম শিক্ষণীয় বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পাটনা, বারাণসী, আগ্রা, নাগপুর, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, বরোদা, রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত পাঠক্রম হিসাবে গৃহীত হয়েছে। প্রয়াগ, লখ্নৌ, কানপুর, বারাণসী, মুম্বাই, কলকাতাতে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে সঙ্গীত সম্মেলন।

স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীত শিক্ষা দানের জন্য উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনসাধারণের মধ্যে সঙ্গীত বিষয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ওস্তাদ মুন্‌শি রইসউদ্দীন, বারীন মজুমদার, অধ্যক্ষ সুরেশ চক্রবর্তী, ওস্তাদ ফজলে হক, পণ্ডিত জগদানন্দ বড়ুয়া, নীরদবরণ বড়ুয়া, ওস্তাদ মিহির লালা, পণ্ডিত রামকানাই দাস, সুধীন দাশ, সনজিদা খাতুন প্রমুখগণ অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে তোলেন সঙ্গীত বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়। ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় গড়ে উঠে শিল্পকলা একাডেমী। আজকাল নিয়মিত সঙ্গীত সম্মেলন হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ,বরিশাল, চট্টগ্রাম, ফেনী, সিলেট প্রভৃতি শহরে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এসকল যুগ ও কীর্তিমান সঙ্গীতজ্ঞগণ শুধু এ উপমহাদেশ নয়, সমৃদ্ধ করেছেন বিশ্বসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে।

আধুনিক সময়কাল অবধি ভারতীয় উপমহাদেশে তিন গোত্র(বীণা, তত, আনদ্ধ-ঘন-শুষির গোত্র) মিলিয়ে মোট ১৫৯টি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র, অর্ধশত সঙ্গীতধারা ও নানান সাংগীতিক ঘরানার প্রচলন পাওয়া গেছে। পাশ্চাত্যের সকল কন্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত ধারার ভিত্তি ধরা হয় ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিকে। সেজন্য অনেক সংগীতবিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে সংগীতের আদিভূমি ভারতীয় উপমহাদেশ।

সঙ্গীতের প্রকারভেদ [ জনরা, ধারা, ধরণ, প্রকার] প্রচলিত / অপ্রচলিত বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের সাথে পরিচয় [ Introduction to Music Genres ]

সঙ্গীতের প্রকারভেদ [ জনরা, ধারা, ধরণ, প্রকার] প্রচলিত / অপ্রচলিত বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের সাথে পরিচয় [ Introduction to Music Genres ] : এই বিশ্বজগতের প্রতিটি মুহূর্তই হচ্ছে গতিশীল। বিবর্তনের ধারায় প্রাণী ও বস্তু অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের সন্ধানে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের ভাবনা, সাধনা, কর্ম, আকাঙ্ক্ষা, সৃজনশীলতা – সবকিছুই প্রতিনিয়ত তাড়া দেয় পরিবর্তনের মাধ্যমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে।

ফলশ্রুতিতে জাগতিক বিষয়গুলো পরিবর্তিত হয়ে আমাদের সামনে আসে নতুন রূপে। আর যুগধর্মকে স্বীকার করে আমরা তা গ্রহণ করি। সময়ের এই চলমান প্রবাহে চৌষট্টি কলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যা সংগীত ইতিহাস ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কালে কালে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। অতি প্রাচীনকালে প্রবন্ধ, বস্তু, রূপক ইত্যাদি নামে যে সকল তালযুক্ত নিবদ্ধ গান ও তালবিহীন অনিবদ্ধ গান ছিল কালের বিবর্তনে সেগুলো লুপ্ত হয়ে গেছে।

পরবর্তী সময়ে লুপ্ত হওয়া এ সকল সংগীতধারা ভিন্নরূপে ধ্রুপদ, ধামার ইত্যাদি গানে এবং রুচি পরিবর্তনের ফলে সঙ্গীতের প্রকারভেদ হয়েছে – খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তারানা, ত্রি-বট ইত্যাদি গানে রূপান্তরিত হয়েছে। শাস্ত্রীয় সংগীত নামে পরিচিত এই ধারাটি ছাড়াও লঘু সংগীত নামে আরেকটি ধারা সংগীতে স্থান পেয়েছে।

লঘু সঙ্গীতের প্রকারভেদ গুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে পল্লীগীতি, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, চৈতি, মুর্শিদি, আধুনিক, কীর্তন, লোকসংগীত, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, শ্যামাসংগীত, লালনগীতি, হামদ, নাত, হাছন রাজার গান, মনোমোহন দত্তের গান ইত্যাদি নামে সুপরিচিত।

একসময় কোন সঙ্গীতের প্রকার হয়তো খুব প্রচলিত থাকলেও কালের বিবর্তে আজ তা হারিয়ে অপ্রচলিতর কাতারে চলে গেছে। কিন্তু এই সব কিছুই আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাস। আমাদের দীর্ঘ সময়ের গড়ে ওঠা বর্তমান সঙ্গীত এই ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়েছে।

তাই একজন প্রকৃত সঙ্গীত শিল্পী বা রসিক হতে হলে, এই সঙ্গীতের প্রকার বা সব জনরার সঙ্গীত সম্পর্কে নুন্যতম ধারণা থাকা জরুরী। আমরা সেসব প্রচলিত ও অপ্রচলিত সঙ্গীতের ধারা বা জনরার একটি তালিকা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করছি, আশা করি ভবিষ্যৎ শিল্পী বা সঙ্গীত রসিকদের কাজে লাগবে। বিভিন্ন প্রকারের এই সংগীতগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বর্ণের ক্রমানুসারে প্রদান করা হলো।

অবতার গান [ Avatar Song, Music Genre ] :

হিন্দু ধর্মানুযায়ী ভগবান বিষ্ণু বা নারায়ণ মানবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলে তাঁকে বলা হয় অবতার। হিন্দু মতে বিষ্ণুর দশটি অবতার হচ্ছে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি। চৈত্রসংক্রান্তির গাজন উপলক্ষে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীরা মিলিত হয়ে দশাবতারের ভঙ্গিতে নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে যে গান করে তাকেই বলে অবতার গান।

আধুনিক গান [ Modern Songs, Music Genre ] :

সাধারণত শৃঙ্গার-রসাত্মক চটুল শ্রেণির গানকেই বলা হয়ে থাকে আধুনিক গান। প্রেম-বিরহ-প্রকৃতি-নারী এসবই হচ্ছে আধুনিক গানের বিষয়বস্তু। আধুনিক গানের বাণী ও সুর হয় সাধারণত সহজ, সরল ও চঞ্চল প্রকৃতির। অনেক শ্রোতার কাছে এ কারণেই আধুনিক গানের একটি ভিন্নতর আবেদন রয়েছে। নিম্নে একটি আধুনিক গানের উদাহরণ দেওয়া হলো –

চাঁদের পাড়ায় থাকো নাকি
ঘুম কেড়েছো সুখ কেড়েছো
তুমি ছাড়া শূন্য হৃদয়
জোছনা মাখা সারা অঙ্গ
নদীর ঘাটে জলকে যাও সাঁঝের আঁধার হয় যে উধাও
ডাগর দুটি পদ্ম আঁখি
একটুখানি হাসলে গালে
চন্দ্রালোকে রূপের সাগর
ওগো চাঁদ সুন্দরী
মন করেছো চুরি
এখন কী যে করি ।
ঝলমল ঝলমল করে
রুমঝুম নূপুর পরে
দেখে চাঁদের পরী ॥
টলমল টলমল করে
মিষ্টি টোল পড়ে চাই যে দিতে পাড়ি ।

কবি গান [ Kabigan, Music Genre ] :

দুটি দলের নায়কের (দলনেতা বা দলের প্রধান গায়ক) মধ্যে কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে রচিত কবিতায় সুরারোপ করে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যে সংগীত লড়াই অনুষ্ঠিত হয় তাকেই বলে কবি গান। এই গানকে আঞ্চলিক ভাষায় তরজা গানও বলা হয়ে থাকে।

দুটি দলের মধ্যে উপস্থিত বুদ্ধি ব্যবহারের ক্ষমতা যার যত বেশি কবি গানে সে দলটিই তত বেশি পারদর্শিতা দেখাতে সমর্থ হয়। তৎক্ষণাৎ খেলে এমন বুদ্ধি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত বিষয়ের এই সংগীত লড়াই শ্রোতা-দর্শককে বিশেষ আনন্দ দেয় অত্যন্ত উপভোগ্য এই কবি গান পল্লী অঞ্চলের মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় এক সংগীতশৈলী হিসেবে সমাদৃত।

কাজরি বা কাজলি [ Kajri, Music Genre] :

ভারতের উত্তর প্রদেশে কাজলি দেবীকে কেন্দ্র করে যে সংগীত গাওয়া হয় তাকেই কাজরি বা কাজলি গান বলা হয়ে থাকে। উত্তর প্রদেশের প্রচলিত লোকগীতিগুলোর মধ্যে এই গান বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়াতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় মহিলারা নতুন বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সারারাত ধরে কাজরি গান গেয়ে থাকে। এই পুজোতে ভাই ও ভ্রাতৃসমকে রাখি বাঁধা হয় বলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকেই কাজরি গানের আসরে মিলিত হতে দেখা যায়।

শৃঙ্গার রসপ্রধান কাজরি বা কাজলি গান মির্জাপুর ও বারানসি অঞ্চলে বেশি প্রচলিত ভক্তিরসাত্মক কিছু কাজরি গান রচিত হলেও এর বিষয়বস্তু বিরহ ও মিলনের বিভিন্ন অবস্থা। বারানসিতে ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত ছট পরবের সময়ও কাজরি বা কাজলি গান গাওয়া হয়ে থাকে।

 কীর্তন গানের মতোই এর গায়ন পদ্ধতি এবং কীর্তনীয়া দলের মতোই কাজলি গানেরও পৃথক পৃথক দল থাকে। একজন মূল গায়কের সঙ্গে অন্যান্য সহশিল্পী নিয়ে বসে কাজরি গানের আসর।

কীর্তন বা কীর্তন গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kirtan, Music Genre ]

কীর্তন [ Kirtan ] শব্দের অর্থ হচ্ছে গুণকথন। সাধারণভাবে ঈশ্বরের নাম, গুণ ও লীলাবিষয়ক পদ যখন সুর ও তালবদ্ধ হয়ে উচ্চকণ্ঠে গাওয়া হয় তখন তাকে বলা হয় কীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের লীলা ও গৌরাঙ্গের জীবনগাথা অবলম্বনে রচিত কীর্তন বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীনত্বের দাবি রাখে।

এই গানের সঙ্গে সংগত করা তালগুলো হচ্ছে ছোট দশকোশী (৭ মাত্রা), মধ্যম দশকোশী (১৪ মাত্রা), বড় দশকোশী (২৮ মাত্রা), তেওট (১৪ মাত্রা), ছোট তেওট (৭ মাত্রা), দাসপেড়ে (৮ মাত্রা), দোঠুকি ( ১৪ মাত্রা), চঞ্চুপুট (৮ মাত্রা), ধীরা (৮ মাত্রা), লোফা (৬ মাত্রা), দোজ তাল (১২ মাত্রা), কাটাধরা (১৬ মাত্রা), মদন দোলা (২২ মাত্রা), ইন্দ্ৰভাব (২৬ মাত্রা), গঞ্জন (৩২ মাত্রা), বিষমপঞ্চম (৩২ মাত্রা), বীরবিক্রম (৩৫ মাত্রা), শশী শেখর (৪৪ মাত্রা) ইত্যাদি কীর্তন গানের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে খোল ও মন্দিরা বা করতাল ব্যবহার করা হয়। প্রধানত তিন প্রকারের কীর্তনের কথা জানা যায়। সেগুলো হচ্ছে নামকীর্তন, লীলাকীর্তন ও রসকীর্তন।

নামকীর্তন [ Naam Kirtan :

নামকীর্তনের প্রধান উপজীব্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের নামগান। তাই একে নাম সংকীর্তন, নামগান কিংবা নামাবলিও বলা হয়ে থাকে। নৃত্য হচ্ছে নামকীর্তন গানের অন্যতম অঙ্গ। অষ্টপ্রহর নামকীর্তনে সময়োচিত নানা রাগের অবতারণা করা হয়।

লীলাকীর্তন [ Leela Kirtan ] :

একটি অধ্যায়ের লীলাগানকে বা একই প্রকৃতির লীলাগানকে বলা হয় লীলাকীর্তন। আবার লীলার বিভিন্ন পদের একত্র সমাবেশে হয়ে থাকে পালাকীর্তন। পরবর্তী সময়ে গৌরাঙ্গলীলাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

রসকীর্তন [ Rosh Kirtan ] :

চৌষট্টি রসের অবতারণাসমৃদ্ধ গানকে বলা হয় রসকীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার বিভিন্ন অধ্যায়ে চৌষট্টি রসের পরিবেশ নিয়ে বৈষ্ণব সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। রসকীর্তনে বিভিন্ন অধ্যায়ের একই প্রকার রস অথবা কখনো কখনো দু-তিনটি রসের একত্র সমাবেশ ঘটে। বিভিন্ন স্থান থেকে একই প্রকৃতির রস সন্নিবেশ দ্বারা একটি পূর্ণাঙ্গ গীতসাহিত্য সৃষ্টি করা হলে পালাকীর্তনের উদ্ভব হয়।

আবার লীলাকীর্তন কিংবা রসকীর্তন যখন বিভিন্ন পদকর্তার পদ নিয়ে একত্রে মালা গেঁথে গাওয়া হয় তখন তাকে পদাবলি কীর্তন বলে। আর যখন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ ষোলোবার গাওয়া হয় তখন তাকে বলে ‘সংকীর্তন’। কীর্তনের পাঁচটি অঙ্গ হচ্ছে যথাক্রমে – কথা, দোহা, আখর, তুক ও ছুট।

কথা :

কীর্তনের ভাষা বা গানের বাণীকে বলা হয় কথা। কীর্তন পরিবেশনের সময় গানের কোনো অংশের অর্থ কীর্তনীয়া বা কীর্তন গায়ক বা কীর্তনশিল্পী যখন বুঝিয়ে দেন তখন তাকেও বলা হয় কথা ।

দোহা :

দোহা বলতে বোঝায় শ্লোকভঙ্গির রচনা, সেগুলো কীর্তন শিল্পীগণ আবৃত্তি করে থাকেন।

আখর :

কীর্তনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে আখর।

তুক :

অনুপ্রাসবহুল ও ছন্দময় মিলনাত্মক গাঁথা তুক নামে অভিহিত। কীর্তন শিল্পীগণ এসব তুক রচনা করে মূল গানের সঙ্গে যুক্ত করেন।

ছুট :

কীর্তনের তাল বা পদের অংশবিশেষকে ছুট বলে। কীর্তন পরিবেশনের সময় সম্পূর্ণ পদটি না গেয়ে পদের অংশবিশেষ ছোট তালে গাওয়া হলে তাকে ছুট বলা হয়ে থাকে।

এই পাঁচটি অঙ্গ ছাড়াও কীর্তন গানের আরেকটি অঙ্গ রয়েছে। যার নাম ঝুমুর। কীর্তন অঙ্গে ঝুমুর হচ্ছে এক প্রকার জমজমাট রচনা। আধুনিককালে ছয়টি পদ্ধতিতে কীর্তন গাওয়া হয়ে থাকে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে বর্ণিত হলো –

প্রথম : হাতুটি (হাতটি) সঙ্গে আপাত্তন বা সুর মেল,

দ্বিতীয় : গৌরচন্দ্রিকা সঙ্গে আপাত্তন বা সুর মেল,

তৃতীয় : ঝুমরা (ঝুমুর) ও মাতান

চতুর্থ : গাছ বা মূলগানের সঙ্গে আখর, কাটান ও পর কাটান। অর্থাৎ শাখা-প্রশাখা

পঞ্চম : মিলন বা ঝুমরা (ঝুমুর) এবং

ষষ্ঠ : নামসংকীর্তন।

লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন গাওয়ার ধারা [ Types of Leela and Rosh Kirtan ]

লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন গাওয়ার প্রধান পাঁচটি ধারা প্রচলিত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে – গরানহাটি বা গড়েরহাটি, ঝাড়খণ্ডি, মনোহরশাহী, মন্দারিণী এবং রেনেটি বা রানীহাটি ।

গরানহাটি বা গড়েরহাটি :

শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তিত ধ্রুপদ অঙ্গের কীর্তনই গরানহাটি বা গড়েরহাটি ধারার কীর্তন গান নামে সুপরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের গরানহাটি পরগনার খেতুরি উৎসবে এই ধারার কীর্তন প্রথম গাওয়া হয়, যা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ঝাড়খণ্ডি :

রাঢ় অঞ্চলের লোকগীতির নাম হচ্ছে ঝুমুর। স্থানীয়দের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় এই ঝুমুর গানের সুরের অনুকরণে ঝাড়খণ্ডি ধারার কীর্তন সৃষ্টি করা হয়েছে।

মনোহরশাহী :

মনোহরশাহী পরগনার শ্রীনিবাস আচার্য কর্তৃক প্রবর্তিত ধারাটি মনোহরশাহী কীর্তন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই কীর্তন ধারাতে অভিজাত গীতের অলংকরণ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে মনোহরশাহী পরগনার লোকসংগীতের সুরের ব্যবহার একে শ্রুতিনন্দন করে তুলেছে।

মন্দারিণী :

সরকার মন্দারণের মঙ্গলকাব্যের অনুসরণে সৃষ্ট কীর্তনকে মন্দারিণী ধারার কীর্তন বলে অভিহিত করা হয়।

রেনেটি বা রানীহাটি :

রানীহাটি পরগনার আচার্য শ্যামনন্দ কর্তৃক প্রবর্তিত কীর্তন রেনেটি বা রানীহাটি কীর্তন নামে পরিচয় লাভ করেছে। এই ধারার কীর্তনে সুরের কিছুটা চপলতা পরিলক্ষিত হয়।

খেতুরির মহোৎসব আরম্ভ হতেই বাংলাতে রীতিবদ্ধ কীর্তনের জয়যাত্রা শুরু হয়। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেবের সময়কেই কীর্তন গানের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। এ সময় প্রধানত বৈষ্ণব পদাবলিই ছিল কীর্তন গানের উপজীব্য । সংগীতের আধুনিককালে এসে অপর কয়েকটি গীতিরীতির সঙ্গে কীর্তন নামটি যুক্ত হয়ে তপকীর্তন, কালীকীর্তন ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলোকে কীর্তন বলা যায় না।

পদাবলি রচয়িতা এবং প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব কবি শ্রী চণ্ডীদাসের বিখ্যাত একটি কীর্তন উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো –

বঁধু কী আর বলিব আমি।

জীবনে মরণে জনমে জনমে প্রাণনাথ হয়ো,

তুমি প্ৰাণনাথ হয়ো ॥

এই মিনতি বঁধু আমার শুধু এই মিনতি

আমি ভাবিয়া দেখিনু প্রাণনাথ বিনে

কবে সে পরানে মরি ।।

বাঁচবে নাহে, তুমি বিনে প্রাণ বাঁচবে নাহে;

তুমি রাধার প্রাণকান্ত মণি, তুমি বিনে প্রাণ বাঁচবে নাহে।

সব সমপিয়া একমন হইয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী।

দাসী হলেম, ঐ চরণ দাসী হলেম,

আমার যা ছিল সব সঁপে দিয়ে, ঐ চরণের দাসী হলেম

চণ্ডীদাস কহে পরশ রতন গলায় গাঁথিয়া পরি।

বঁধু গলায় গাঁথিয়া পরি ।।

[গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী চণ্ডীদাস, তাল: একতাল (১২ মাত্রা তাল ফেরতা)

খেয়াল বা খেয়াল গান – সঙ্গীত শৈলী [ Kheyal, Music Genre ]

ফারসি ভাষা ‘খ্যাল’ থেকে উদ্ভূত খেয়াল [ Kheyal ] শব্দের অর্থ হচ্ছে বিচার বা কল্পনা। সাংগীতিক পরিভাষায় খেয়াল হচ্ছে একধরনের শাস্ত্রীয় সংগীত যাকে উচ্চাঙ্গ বা রাগসংগীতও বলা হয়ে থাকে। নানাবিধ তান, বোলতান, আলাপ, বিস্তার, গায়কি, বো-বাঁট, সারগাম, তেহাই ইত্যাদি সহযোগে বিভিন্ন তালে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে রাগ গাওয়া হলে তাকে বলে খ্যয়াল বা খেয়াল। এর উৎপত্তি সম্পর্কে নানাবিধ মতবাদ প্রচলিত থাকলেও মূলত কাওয়ালি গান থেকেই খেয়াল গানের সৃষ্টি হয়েছে।

মুসলিম রাজত্বকালে পাঠান বংশোদ্ভূত দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির (১২৯৬-১৩১৬) রাজদরবারের উচ্চ পর্যায়ের সভাসদ ছিলেন সংগীতজ্ঞ হজরত আমির খসরু ওরফে আবুল হাসান। তিনি নিজ আবিষ্কৃত কাওয়ালি গানের সংস্কার করেন। অতঃপর নানাবিধ গবেষণা, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে সংস্কারকৃত সেই কাওয়ালি গানে একটি প্রথাসিদ্ধ রূপদানের মাধ্যমে খেয়াল গানের উদ্ভব করেন।

এই গানের বিষয়বস্তু প্রধানত শৃঙ্গার রসাত্মক হলেও গানে ভক্তিরসের প্রাধান্যও পরিলক্ষিত হয় এবং সংগীতের শিল্প সৌন্দর্যের মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে। হিন্দি, উর্দু পাঞ্জাবি এই তিন ভাষায় খেয়াল গান রচিত হলেও অনেক সময় একই গানে হিন্দি উর্দু উভয় ভাষারই সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। গাম্ভীর্য কম বলে খেয়াল গানের সঙ্গে তবলা-বাঁয়া সংগত করা হয়ে থাকে।

এই গানে একতাল, ত্রিতাল, আড়া চৌতাল, ঝুমরা ইত্যাদি তালের ব্যবহার বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। খেয়াল গান দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যথা – দ্রুত বা ছোট খেয়াল এবং বিলম্বিত বা বড় খেয়াল।


দ্রুত বা ছোট খেয়াল :

খেয়াল গানের আবিষ্কারক হজরত আমির খসরু ওরফে আবুল হাসান কাওয়ালি গানের সংস্কার করে উপহার দেন দ্রুত বা ছোট খেয়াল এর দুটি বিভাগ যথাক্রমে স্থায়ী এবং অন্তরা। প্রতিটি বিভাগে দুটি বা তিনটি করে চরণ থাকে। ছোট খেয়াল চপল গতির বলে এর ভাষা সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে।

এ গানের বন্দিশ সাধারণত ত্রিতাল, ত্রিমাত্রিক একতাল ঝাঁপতালে বাঁধা হয়। ছোট খেয়ালে বিস্তার করার সুযোগ নেই। প্রথমে মধ্যলয়ে এবং তারপর দ্রুতলয়ে গেয়ে ছোট খেয়াল পরিবেশন করা হয়। রাগের শুদ্ধতা বজায় রেখে স্বাধীনভাবে শিল্পী গিটকিরি, কণ, তান, বোলতান, সরগম ইত্যাদি অলংকরণে দ্রুতলয়ে গেয়ে থাকেন। এই গানে শৃঙ্গার ছাড়া অন্য রসেরও প্রাধান্য ঘটে এবং কিছু হালকা রাগ ছাড়া প্রায় সব রাগেই দ্রুত বা ছোট খেয়াল শুনতে পাওয়া যায়।

বিলম্বিত বা বড় খেয়াল :

বিলম্বিত বা বড় খেয়াল পঞ্চদশ শতাব্দীতে জৈনপুরের সুলতান হুসেন শাহ শর্কি কলাবন্ত খেয়াল প্রবর্তন করেন, যা বিলম্বিত বা বড় খেয়াল বলে সুপরিচিত। এই খেয়ালেরও স্থায়ী এবং অন্তরা নামে দুটি তুক বা বিভাগ বিদ্যমান। বিলম্বিত বা বড় খেয়ালের গতি-প্রকৃতি ধীরস্থির ও গম্ভীর হয়ে থাকে। এতে শৃঙ্গার রস ছাড়াও ভিন্ন প্রকৃতির আরো বহুবিধ রসের আবির্ভাব ঘটে।

বড় খেয়ালে বিলম্বিত লয়ে বিশেষ রীতিতে আলাপ করা হয়, যাকে বলে বিস্তার। গানের সঙ্গে আ-কার কিংবা গানের বাণী সহযোগে ধীর মন্থর গতিতে বিস্তার করা হয়। এর এবং ‘অন্তরা’ উভয় ভাগেই বিস্তার হবার পর চারগুণ ও আটগুণ লয়ে অধিকাংশ তান হয়। অবশ্য কোনো কোনো সময় বড় খেয়ালে অতিরিক্ত আরো দুটি বিভাগ ‘সঞ্চারী’ ও ‘আভোগ’ পরিলক্ষিত হলেও চারটি বিভাগের খেয়াল গানের সংখ্যা খুবই কম।

বড় খেয়ালের স্বরবিস্তারের প্রক্রিয়াটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় গানের মাধ্যমে শিল্পী রাগের ভাবরূপসহ নিজ শিল্পীসত্তাকে প্রস্ফুটিত করে তোলেন। স্বরবিস্তারের শৈলীর মাধ্যমেই শিল্পী কোন ঘরানার অনুসারী তা সংগীতরসিক শ্রোতারা বুঝতে পারেন। এতে বিভিন্ন প্রকারের মিড়, গমক, তান, বোলতান ইত্যাদি অলংকরণ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

গম্ভীর চলনের বিলম্বিত বা বড় খেয়ালে কণ বা স্পর্শস্বরের ব্যবহার গানের সৌন্দর্যকে আরো বেশি বৃদ্ধি করে। হালকা অঙ্গের রাগ ছাড়া অন্য সব রাগেই বড় খেয়াল গাওয়া হয়। এই গানে তবলা-বাঁয়া সহযোগে বিলম্বিত একতাল, আড়া চৌতাল, তিলোয়াড়া, ঝুমরা ইত্যাদি তালের সংগত প্রচলিত রয়েছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ রঙ্গিলের রাজদরবারের অন্যতম সভারত্ন এবং তৎকালীন স্বনামখ্যাত খেয়ালগায়ক ও বীণাশিল্পী ওস্তাদ নিয়ামত খাঁ (সদারঙ্গ) অজস্র খেয়াল গান রচনা করেন। এতে বিভিন্ন প্রকারের মিড়, গমক, তান, বোলতান, কণসহ বিভিন্ন অলংকারাদি প্রয়োগ করে তিনি নতুন ও আকর্ষণীয় রূপে খেয়াল গানের প্রচলন করেন।

শিষ্যদের তিনি যে খেয়ালরীতি শিক্ষা দেন, পরবর্তীকালে শিষ্যপরম্পরায় তাই প্রচার এবং প্রসার লাভ করে। যথাযথ তালে ও সঠিক নিয়মানুযায়ী পরিবেশন করতে পারলে খেয়াল গান শ্রোতা-দর্শক হৃদয়ে অপূর্ব আনন্দের সঞ্চার করে। পিতার পথ অনুসরণ করে ওস্তাদ ফিরোজ খাঁ ওরফে অদারঙ্গ খেয়াল গানের উন্নতিতে অসামান্য অবদান রাখেন।

বর্তমানে বেশিরভাগ খেয়ালশিল্পী প্রথমে বিলম্বিত এবং পরে ছোট খেয়াল পরিবেশন করে থাকেন। খেয়াল গানের বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, প্রকৃতি ও ভক্তি (ঈশ্বরের স্তুতি) এই তিনটি বিষয়ের প্রাধান্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগ রচনাতেই প্রেমের প্রাবল্য অধিক পরিলক্ষিত হয়। তাই সংগীতজগতে খেয়াল অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অধিক প্রচলিত একটি গীতধারা। শাস্ত্রীয় সংগীতের শাখাগুলোর মধ্যে খেয়াল গানই এখন সব থেকে এগিয়ে রয়েছে।

খেয়াল গানের বৈশিষ্ট্য :

• আ-কার, ই-কার, উ-কার ইত্যাদি সহযোগে খেয়াল আরম্ভের পূর্বে তালছাড়া এবং আরম্ভের পরে তালযুক্ত আলাপ (এ সময় শিল্পীর স্বকীয়তা, বিচক্ষণতা ও সৃজনীশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে অধিক সময় আলাপ করলেও একঘেয়েমি লাগে না)।

• সরগম, বোলতান, তেহাই এবং তার পূর্বে গানের বাণী সহযোগে নতুনত্ব আনয়ন।

• রাগের ভাব ও রসের গভীরতা।

• ধ্রুপদ অপেক্ষা শব্দবিন্যাস কম।




Comments

Popular posts from this blog

Drama and Art Education // নাটক এবং শিল্পশিক্ষা

Practicum Paper: Calendar Chart on Various Musical Instruments

Practicum Paper on "Developing a Creative Book Cover Design"